পরপর তিনটে তেউরে ওঠা বীভৎস গোঙানির আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেল। রাত এখন কত, জানি না। নক্ষত্রের কম্বলে মোড়া রাতের আকাশটা কেমন যেন ধূসর মেঘাচ্ছন্ন লাগছে।
আওয়াজটা আবার আসতেই এবার চমকে উঠলাম। হ্যাঁ। তিন্নির ব্যথায় কাতর হওয়া গোঙানির আওয়াজ। আবার—আবার—আবারও। জখম বাঘিনীর এ ডাক যে বড় ভয়ঙ্কর!
একটু আগেই সার্কাসের ডেঞ্জার জোনের গেট খুলিয়ে জখম তিন্নিকে প্রায় দেড় সের ভাতের মাড়ের সঙ্গে একটা গোটা সেদ্ধ মুরগি, সেইসঙ্গে ডাক্তারের দেওয়া ঘায়ের ওষুধ খাইয়ে এসেছি। দু’পাশ থেকে খাঁচার লোহার বেড় ঘন করে এনে তিন্নিকে হাঁ করিয়ে একটা ছোট মগ দিয়ে নিজের হাতে ওর মুখে ঢেলে ঢেলে খাইয়ে দিয়েছি। তাই আবারও তিন্নির ভয়ঙ্কর হুঙ্কারে আস্তে আস্তে বাঘসিংহের এনক্লোজারে তিন্নির ছোট্ট খাঁচার সামনে এসে দাঁড়ালাম। তিন্নি আর কেউ নয়। এই ‘রমণী’ সার্কাসে টানা সাত বছর খেলা দেখানো এক বৃদ্ধা বাঘিনী। এখন ডান পায়ের থাবা আর লেজে বিষাক্ত ঘা নিয়ে প্রায় শয্যাশায়ী। তাঁবু বন্দি।
তিন্নির খাঁচার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই মনে হল অন্ধকারে ওর চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। ব্যথায় ছটফট করছে। গুমরে গুমরে হুঙ্কার দিচ্ছে।
তিন্নির সামনে গিয়ে লোহার ছোট্ট খাঁচার বেড় ধরে মোলায়েম গলায় ডাকলাম— তিন্নি! তিন্নি সোনা।
ছোট্ট খাঁচার মধ্যে ভাল করে হাঁটতে চলতে পারছে না তিন্নি। ডান পায়ের থাবার বিষাক্ত ঘা থেকে পুঁজ রক্ত বেরুচ্ছে। লোহার ছোট্ট খাঁচায় ঘষটানি খেতে খেতে লেজেও ধরেছে বিষাক্ত পচন।
আমার গলার আওয়াজ পেয়ে তিন্নি কেমন যেন চুপ করে গেল। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আবারও ব্যথায কঁকিয়ে উঠল। যন্ত্রণায় কাতর মুখটা তুলে একবার আমার দিকে অসহায় চোখে তাকাল। তারপর লালাভর্তি জিভটা দিয়ে থাবা চাটতে চাটতে কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়ল।
এবার নিচু হয়ে বসে মনে সাহস সঞ্চয় করে ছোট্ট খাঁচার রডের ভেতর হাতটা গলিয়ে তিন্নির মাথায় রাখলাম। মাথায় মানুষের স্পর্শ পেয়ে হয়তো খানিকটা ভয়েই ও সরে গেল খাঁচার অন্য পাশে। আমিও হাতটা বাড়িয়ে ওদিকটা যেতেই কে যেন আমার কাঁধটা পেছন থেকে চেপে ধরে হুঙ্কার দিয়ে উঠল— নো। নেভার। ইউ কান্ট টাচ্ তিন্নি।
চমকে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি রমণ সাহেব। এই ‘রমণী’ সার্কাসের মালিক। তার পেছনে রিং মাস্টার মজিদ সাব। আমাকে চুপ করিয়ে মজিদ সাব বললেন— তিন্নি অউর নেহি বাঁচেগা। উনকো সারে বডি গ্যাংগ্রিন হো গিয়া। আভি উনকো ছুট্টি মিলনা চাহিয়ে।
—ছুটির দরকার? অবাক হয়ে অন্ধকারে তাকিয়ে থাকি মজিদ মাস্টারের মুখের দিকে। মজিদ মাস্টার এবার রমণ সাহেবের দিকে তাকাল। রমণ সাহেবের চোখ দিয়ে টপটপ করে জল পড়ছে। ভয়ার্ত অস্ফুট ঠোঁট দিয়ে বেরিয়ে এল একটা স্নেহমাখানো শব্দ— তিন্নি। তিন্নি— মাই বেবি।
একবার রমণ সাহেবের দিকে আর একবার তার প্রিয় রিং মাস্টার মজিদের দিকে যন্ত্রণামাখা চোখে তাকাল তিন্নি। একটা যন্ত্রণাক্লিষ্ট আওয়াজ বেরিয়ে এল গলা দিয়ে— হুউম।… অন্ধকারে চোখ সয়ে আসতে দেখি, রমন সাহেব কোর্টের পকেট থেকে রিভলবারটা বের করে মজিদ মাস্টারের হাতে ধরিয়ে দিয়েই তিন্নির খাঁচাটা মুঠো করে ধরে হু-হু করে শিশুর মতো কেঁদে উঠলেন। –ওঃ মাই বেবি, প্লিজ ফরগিভ মি। ফরগিভ মি।…
ভাগ্যের ফেরে কিংবা বোহেমিয়ান জীবন নিয়ে তখন ঘুরে বেড়াচ্ছি এ-শ্মশান থেকে সে-শ্মশান।
আজ এ-শহরে, তো কাল ও-শহরে। পাক্কা ভবঘুরের জীবন। এভাবেই একদিন নিজের অজান্তেই জড়িয়ে পড়লাম এই গঞ্জের সার্কাস পার্টির সঙ্গে। গঞ্জের বড় সার্কাস। সারাবছরই তাঁবু পড়ত এ-শহর থেকে সে-শহরে। লোকের মুখে মুখে ফিরত ‘রমণী’ সার্কাসের সব বাহাদুরি খেলা।
নিজের খাঁচা থেকে বেরিয়ে রিংয়ের ওপর রাখা একটা কাঠের পাটাতনের ওপর দিয়ে তিন্নি আসবে রাজকীয় ভঙ্গিতে। রিংয়ে এসে প্রথমেই সে সামনের থাবাদুটো একটা কাঠের টুলের ওপর বসিয়ে রাজকীয় ভঙ্গিতে হুঙ্কার ছাড়বে। রিং মাস্টার মজিদ সাহেবের কথামতো একবার ডানদিকে একবার বাঁ দিকে চক্কর দেবে। হাত মেলাবে। তারপর একটা বড় লোহার রিঙে আগুন জ্বালানো হলে তিন্নি বড় বড় লাফ দিয়ে সেই আগুনের মধ্যে গলে যাবে।
প্রথম শুরু হত একটা সরু লম্বা দড়ির ওপর চারটে মেয়ের হেঁটে যাওয়ার খেলা। তারপর হাতলবিহীন দুটো সাইকেলের চাকার কসরত সেই দড়ির ওপর। তারপর দড়ির সিঁড়ি থেকে একবার এদিক একবার ওদিক, প্রায় দশ ফুট দূরত্বের লাফ। হাড় হিম করা সেই খেলায় একবার হাত ফসকালেই শেষ। আঁটোসাঁটো রঙিন কস্টিউমে অসামান্য দেহসৌষ্ঠব আর যৌন আবেদনে ভরা সে খেলা দেখতে দেখতে দর্শকদের প্রাণ জুড়িয়ে যায়। ট্রাপিজের খেলা শেষ হতেই আসবে একজন চিনেম্যান গোছের ঢ্যাঙা লোক। একটা-দুটো-তিনটে-চারটে বল নিয়ে সে দেখাবে জাগলিঙের খেলা। ছেলেরা অবাক হয়ে দেখত একটা বলও ওর হাত থেকে বেরিয়ে য়াচ্ছে না। তারপর উমেশ সিং আসত কাঁধে মাথায় অনেকগুলো টিয়া আর একটা কাকাতুয়া নিয়ে। পাখিগুলো নাচবে, কথা বলবে। মানুষের গলায় কুৎসিত গালাগালি দেবে। দর্শকদের সে কী উল্লাস! এরপর আসবে সোফিয়া সুন্দরী। একটা রঙিন দু’চাকার সাইকেলে সে কতরকম খেলা দেখাবে। এরপর একটি মেয়ে নিয়ে আসবে ইয়া বড় এক অ্যালসেশিয়ান কুকুর। চলন্ত সাইকেলে বসে সেও দেখাবে দারুণ দারুণ সব খেলা। এরপর দু-চারটে জোকারের ছ্যাবলামির পর দশ মিনিটের বিশ্রাম। তারপরই শুরু হতো ‘রমণী’ সার্কাসের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রোমহর্ষক খেলা— তিন্নি হামারা বেটি হ্যায়।
নিজের খাঁচা থেকে বেরিয়ে রিংয়ের ওপর রাখা একটা কাঠের পাটাতনের ওপর দিয়ে তিন্নি আসবে রাজকীয় ভঙ্গিতে। রিংয়ে এসে প্রথমেই সে সামনের থাবাদুটো একটা কাঠের টুলের ওপর বসিয়ে রাজকীয় ভঙ্গিতে হুঙ্কার ছাড়বে। রিং মাস্টার মজিদ সাহেবের কথামতো একবার ডানদিকে একবার বাঁ দিকে চক্কর দেবে। হাত মেলাবে। তারপর একটা বড় লোহার রিঙে আগুন জ্বালানো হলে তিন্নি বড় বড় লাফ দিয়ে সেই আগুনের মধ্যে গলে যাবে। মেজাজ ভাল থাকলে একবার-দু’বার-তিনবার। আর তার মনমর্জি না হলেই এক লাফ দেখিয়েই ঢুকে পড়বে নিজের খাঁচার মধ্যে। হাততালিতে ফেটে পড়বে তাঁবু।
রমণ সাহেবের কাছে শুনেছিলাম এক তেলুগু ছোট্ট সার্কাস থেকে তিনি কিনে এনেছিলেন এই ছোট্ট বাঘিনীর ছানাটাকে। নিজের হাতে মাংসের স্বাদ দিয়ে ওকে বড় করে তুলেছেন। তিন্নির স্বভাবটা ছিল বড় মোলায়েম। আদর পেলে ছোট্ট শিশুটির মতো ঘুরঘুর করত। কোনও হিংস্রতা বা জঙ্গুলে বা বুনোটে স্বভাব ছিল না তার। একটু বড় হলে রমণ সাহেবই ওকে ট্রেনিং করিয়েছেন। ওজন মেপে খাইয়েছেন। নখ আর দাঁতের পরিচর্যাও নিজের হাতে করেছেন। আগে তিন্নির খেলা উনিই দেখাতেন। এখন মজিদ মাস্টার দেখায়। মানুষের মতো জন্তু-জানোয়ারেরও একটা বয়স থাকে। শরীরে রোগের উপদ্রব বাড়ে। কিন্তু তিন্নিকে যে মারণ রোগ ধরবে তা কেউ ভাবতেও পারেনি।
সার্কাসে চলে দিনে-রাতের খেলা। ভোর থেকে শুরু হয় কসরৎ। নানা খেলার নানা কায়দা। জেনানা তাঁবুর পাশেই রান্নার জায়গা। একটা মানুষের আর একটা পশুদের। সার্কাসের জীবজন্তুদের জন্য নিয়মিত ডাক্তার আসে।
মজিদ মাস্টারের নিষ্ঠুর প্রশ্নে আমার বুকের ভেতরটা যেন থরথর করে কেঁপে উঠল। ফের মজিদ মাস্টার শুধালেন— কেয়া করে সাব? রাত খতম হোনে সে পয়লাই যো কুছ করনা পড়েগা।
রাত পর্যন্ত শো চলে। তারপর শুরু হয়ে যায় নরক। তাঁবুর আনাচে-কানাচে বসে মদ আর জুয়ার আসর। তারপর রাত গভীর হলেই সার্কাসের মালিক রমণ সাহেব আর রিং মাস্টার মজিদের ঘরে পালা করে যেতে বাধ্য হয় ট্রাপিজের মেয়েরা। আবার ভোর হতে না হতেই অন্য জীবন। ট্রাপিজের ওঠানামা খেলার মতোই এদের জীবন বড় প্রাণবন্ত। একে অন্যের জন্য প্রাণ দিতে পারে। ঘর ছেড়ে, সংসার ছেড়ে কত না সুখ-দুঃখের সাথী এরা। এই গত রবিবার অল্পবয়সি জোকার হরির মা মারা যাবার খবর পেয়ে শো শেষ হলেই অনেক রাত পর্যন্ত রিংয়ের মাঝখানে সবাই গোল হয়ে বসে হরিকে সান্ত্বনা দিয়েছে। ভোলাতে চেষ্টা করেছে ঘর ছাড়ার দুঃখ।
আস্তে আস্তে রাত শেষ হয়ে আসছে। যেন এই সার্কাসের রঙিন তাঁবুর ওপর উষার প্রথম আলো এদের হাজারো সুখ-দুঃখের ওপর প্রলেপ দিচ্ছে। যন্ত্রণায় অস্থির তিন্নি কেমন যেন করছে। গোঙাচ্ছে। ডুকরোচ্ছে। হাঁফাচ্ছে। সাবানের ফেনার মতো ঘন ঘন লালা বেরিয়ে আসছে মুখ থেকে।
–কেয়া করে সাব?মার দিই?
মজিদ মাস্টারের নিষ্ঠুর প্রশ্নে আমার বুকের ভেতরটা যেন থরথর করে কেঁপে উঠল। ফের মজিদ মাস্টার শুধালেন— কেয়া করে সাব? রাত খতম হোনে সে পয়লাই যো কুছ করনা পড়েগা।
–নেহি— নেহি। ডোন্ট শুট তিন্নি। বুকের মধ্যে রিভলবারটা চেপে ধরে হু-হু কান্নায় ভেঙে পড়লেন রমণ সাহেব।
ঠিক সেই সময়েই আসন্ন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে লড়তে ভয়ঙ্কর যন্ত্রণায় তিন্নি শেষবারের মতো খাঁচার ভেতর উথালি পাথালি করতে লাগল। ভয়ে দিশেহারা হয়ে রমণ সাহেবের পিস্তল গর্জে উঠল। শেষবারের মতো লোহার ছোট্ট খাঁচায় পা দুটো টানটান করে লুটিয়ে পড়ল তিন্নি।
–এ ম্যায়নে কেয়া কিয়া? হম তিন্নিকো মার দিয়া? ও গড্ হোয়াট আই ডিড্? অই কিল্ড তিন্নি? নো, নো! ইট কান্ট বি ডান!
কেমন যেন সব বেভুল হয়ে গেল মুহূর্তের মধ্যে। তিন্নির খাঁচায় ঝোলানো তালাটাকে হাত দিয়ে দুমড়ে মুচড়ে ভাঙার চেষ্টা করতে লাগলেন রমণ সাহেব। তিন্নির শরীরটা ছোঁয়ার জন্য পাগলের মতো করতে লাগলেন। লোহার খাঁচায় বিঁধতে বিঁধতে রক্ত ঝরতে লাগল শরীর থেকে।
বিমূঢ় মজিদ মাস্টার। স্তব্ধ হতবাক আমি। খাঁচার সামনে পড়ে রয়েছে রমণ সাহেবের রিভলবারটা।
তিন্নির খাঁচার ওপর আকুলি-বিকুলি করছেন রমণ সাহেব। হাসছেন— কাঁদছেন— ডুকরোচ্ছেন। রমণ সাহেব পাগল হয়ে গেছেন।…
শনিবারের চিঠি, শারদ সংখ্যা, ১৪২৬